Header Ads

Header ADS

সংখ্যার ইতিহাস ।

 

সংখ্যার ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, প্রাচীন মিসরের পুরোহিত সম্প্রদায়ের গণিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণিতের আনুষ্ঠানিক অভিষেক ঘটে। তাই সংখ্যাভিত্তিক গণিতের সৃষ্টি যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর আগে। স্বাভাবিক সংখ্যা গণনার প্রয়োজনে প্রাচীন ভারতবর্ষের গণিতবিদেরা সর্বপ্রথম শূন্য ও দশভিত্তিক স্থানীয় মান-পদ্ধতির প্রচলন করেন, যা সংখ্যা বর্ণনায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। ভারতীয় ও চীনা গণিতবিদেরা শূন্য, ঋণাত্মক, বাস্তব, পূর্ণ ও ভগ্নাংশের ধারণার বিস্তিৃতি ঘটায় যা মধ্যযুগে আরবীয় গণিতবিদেরা ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ অব্দের কাছাকাছি গ্রিক দার্শনিকেরা ও জ্যামিতিক অঙ্কনের প্রয়োজনে অমুলদ সংখ্যা, বিশেষ করে দুই-এর বর্গমূলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় গণিতবিদেরা বাস্তব সংখ্যাকে প্রণালিবদ্ধ করে, পূর্ণতা দান করেন। জার্মান গণিতবিদ রিচার্ড ডেডিকাইন্ড (Richard Dedekind ১৮৩১- ১৯১৬) গণিতের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে বিমূর্ত গণিত (Abstract Algebra) বীজগণিতীয় সংখ্যাতত্ব ও বাস্তব সংখ্যার ভিত্তিমূলে তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি ডেডিকাইন্ড কাটের (Dedekind Cut) সাহায্যে অমুলদ সংখ্যাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন। দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাস্তব সংখ্যা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সুম্পষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। 

ধরে নেয়া হয়, মানব সভ্যতার সুচনালগ্নে সংখ্যার (Number) ধারনার কোন অস্তিত্ব ছিল না অর্থাৎ, আদিম মানুষ (Primitive Human) সংখ্যা কি তা জানত না, সংখ্যার অস্তিত্ব কিভাবে হলো, কিভাবে মানুষ গুনতে শিখল, এইসব ইতিহাস ঐতিহাসিকদের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। সংখ্যার ধারনা আসে সভ্যতার সূচনারও পরে।  

উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরা এটা আবিষ্কার করেন যে, অনেক পশু-পাখিই ৫ পর্যন্ত গুণতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন মানুষেরা এটাও পারতো না। তাদের আর দোষ দিয়ে কি হবে? এখনও পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে; যারা এখনো এক (১), দুই (২) এবং তিন (৩)-এর বেশি গণনা করতে পারে না।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাণিতবিদগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সূচনা হয়েছে গণিতের সবেচেয়ে কিউরিয়াস শাখা “নাম্বার থিওরি” (Nuber Theory) বা “সংখ্যাতত্ত্ব” গাইস, অয়লার, ফর্মার মত শত শত গণিতবিদতদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার ফলে তিল তিল করে সমৃদ্ধ হয়েছে গণিতের এই শাখা।  

০ (শূন্য ) 

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলোর অন্যতম হলো শূন্য। দিলীপ এম সালভীর মতে, “শূন্য গণিতের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করেছে, এর কার্যকারিতা, সূক্ষতা, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে।” শূন্য সাংস্কৃতিক শব্দ। আরবী ভাষায় এর অর্থ হলো ফাঁকা বা খালি জায়গা। শূন্যের উৎপত্তি হয়েছিল ভারতবর্ষে। গ্রীক দার্শনিক টলেমী কিছু না বুঝাতে একটি ক্ষুদ্র বৃত্ত ০ ব্যবহার করেন। ইহা গ্রীক 'Ouser'-এর প্রথম শব্দ। Ouser-এর অর্থ কিছুই না। প্রাচীন কালে শূন্য বলতে কেন্দ্র চিহ্নিত বৃত্তকে বুঝাতো। আর কোন সংখ্যার অর্থে শূন্যের উদ্ভব ঘটে। 

শূন্য বলতে যে চিহ্নটি ব্যবহার করা হয় তা হলো ০। ঐতিহাসিকদের মতে, গ্রীকরা কিছু না বুঝাতে ‘Omicron’ শব্দটি ব্যবহার করত যা Ouden নামে পরিচিত। আর তখন থেকে ‘০’ চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়। অন্য একমতে, মান বিহীন একটি মুদ্রা যার নাম ছিল Obal। এই Obal থেকেও ০ চিহ্নটি আসতে পারে। তবে নাম বুঝাতে শূন্য ইংরেজি প্রতিশব্দ Zero থেকে এসেছে যা আরবী  Sife থেকে এসেছে। দশম শতাব্দীতে আরবীয়রা যখন ভারতীয় সংখ্যা লিপি গ্রহণ করে, তখন শূন্য শব্দটি অনুবাদ করছিলো ‘সিফর’ বলে। আরবী সিফর শব্দটি ইতালিয় ভাষায় ‘জেফিরো’ থেকে এসেছে ‘জিরো’। 

খ্রিষ্টীয় যুগ সৃষ্টির আগে ভারতীয়রা শূন্য সম্পর্কে জানত বলে ধারণা করা হয়, এ কথা প্রাচীন ভবিষ্যতের দ্রষ্টা ফিঙ্গলা এবং কৌঠিল্য অনেকবার তাদের সাহিত্যকর্মে উল্লেখ করছেন।

 বিখ্যাত আরবীয় গণিতবিদ আল-থারেজর্মীর ৮২৫ সালে লেখা একটি গ্রন্থে বলেছেন ভারতীয়রা গণিত শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেছেন। মধ্য আমেরিকার মায়ারাও শূন্যের উদ্ভাবন করেন। ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ও শূন্য সম্পর্কে জানত। গ্রীক, ব্যাবিলন, মধ্য আমেরিকা ও ভারতীয়রা শূন্য আবিষ্কার করলেও; ভারতীয়রা-এর তাৎপর্য বুঝতে পেরে শূন্য কে সংখ্যা হিসাবে গ্রহণ করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে পশ্চিম ব্যাবিলনের মেসোপটেমীয়া শহরে পাওয়া একটি ফলকে শূন্য বুঝাতে দুই কীলক (“) চিহ্ন ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন- ৯০৩ বা ৯ “৩। ১০৩ সালে টলেমী খালি স্থান বুঝাতে ০ চিহ্নটি ব্যবহার করেন, তবে সংখ্যা হিসাবে ব্যবহার শুরু হয় ৫৬০ সালে। ভারতে যা ২০০ সাল থেকেই প্রচলিত ছিল। 

৫০০ সালে আর্যভট্টের প্রচলিত সংখ্যা পদ্ধতিতে স্থানিক মান বুঝাতে “খ” শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় শূন্য। আর্কিমিডিস “স্যান্ড রেকনার” গ্রন্থে যে সংখ্যা পদ্ধতি বর্ণনা করেন, তাতে শূন্য রাশিটি ছিল না। মায়া সভ্যতায় স্থানিক অংকপাতনে শূণ্য ব্যবহার দেখা যায়। 

আর্যভট্ট তার ‘মহাসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে বলেছেন শূন্যকে কোন সংখ্যার সাথে যোগ করলে বা বিয়োগ করলে সংখ্যাটি অপরিবর্তিত থাকে। শূন্য দিয়ে কোন সংখ্যাকে গুণ করলে গুনফল শূন্য হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

ব্রহ্মগুপ্তের গবেষণা পরবর্তীতে ভাঙ্করাচার্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভাঙ্করাচার্য ব্রহ্মগুপ্তে-কে ‘গনক চুড়ামনি’ উপাধি দেন। শূন্য আবিষ্কারে এই ভাঙ্করাচার্যের অনেক অবদান আছে। খ্রিষ্ট পূর্বঃ ২০০ সালে পিঙ্গল শূন্য’র ব্যবহার করেন কিন্তু তিনি যে, এর আবিষ্কারক এ দাবী তিনি করেনি। ভাঙ্কারাচার্য তার ‘লীলাবর্তী’ গ্রন্থে বলেন ‘শূন্য দ্বারা কোন সংখ্যাকে বিভাজিত হলে, ভাগফল অসীম হবে’। 

বাগদাদের খলিফা আল-মনসুরের শাসনামলে এক দল পন্ডিতকে ছদ্মবেশে ভারতবর্ষে পাঠান। উদ্দেশ্য ভারতীয় চিকিৎসা গণিত ও জোর্তিশাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা। এভাবে শূন্য আরবে আর সেখান থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।। ভারতীয় শূন্য আরবীয়রা আরো জনপ্রিয় করে তোলেন, যার মধ্যে আল খোয়ারিজমী অন্যতম। আল-খোয়ারিজমী ভারত সফর করেন ও বাগদাদে গিয়ে লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ “হিসাব-আল-জাবরা-ওয়া-আল-মোকাবেলা” সেখানে শূন্যকে বলা হয়েছে সিফর। বাংলায় শূন্যকে  গগন, আকাশ, নভো ইত্যাদি নামে। 

ইউরোপীয়দের মতে সংখ্যা হলো গুপ্ত লিখনের চাবিকাঠি বা সাংকেতিক ভাষা আর গুপ্ত চাবিকাঠি হল ইংরেজিতে ‘Cipher’। ভারতীয় শূন্য যখন ইউরোপে প্রবেশ করে তখন এর অন্তর্গত মুক্তি সম্বন্ধে উপলব্দি করে, আর শূন্য হয়ে দাঁড়ায় অসীম সম্ভাবনার দ্বার। আজকে বাইনারি গণিতের মূলে রয়েছে ০ ও ১। 

বর্তমান গণিতের জন্ম হয়েছে গণনা থেকে। কেননা গণনার ধারনা থেকেই প্রথম সংখ্যা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভত হয়েছিল। যদিও সংখ্যার জন্ম হয়েছে অনেক সময়ের ব্যবধানে। প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ যখন গুহায় বসবাস করতো তখনও এক -দুই পর্যন্ত গণনা করতো, তখনও এক, দুই পর্যন্ত গণনা চালু ছিল বলে ধারণা করা হয়। তখন পারিবারিক বা সামাজিক জীবন ভালো করে শুরু না হলেও পদার্থের রূপ সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল ছিল। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য আহরণ, উপাদান এবং সঞ্চয় করতে শুরু করে। মৃৎ, কাষ্ঠ এবং বয়ন শিল্পের প্রসার ঘটে যার অনেক নমুনা বর্তমানে আবিষ্কৃত হয়েছে।

অধিকাংশের মতে এ সময়েই ভাষার বিকাশ ঘটে। তবে ভাষা যতটা বিকশিত হয়েছিল তার তুলনায় সংখ্যায় সংখ্যার ধারণা ছিল বেশ অস্পষ্ট। সংখ্যাগুলো সবসময় বিভিন্ন বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতো। যেমন- পশুটি, দুটি হাত, একজোড়া ফল, এক হাঁড়ি মাছ, অনেক গাছ, সাতটি তারা ইত্যাদি। এমনকি অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং আফ্রিকার অনেক গোত্র দুশো বছর আগেও এ অবস্থায় ছিল।

No comments

Powered by Blogger.